আমার বাবা : ক্রম -হ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বিধি
চন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়
(A snippet from
‘Nothing to hide under the carpet: A Reminiscences by Chandan Bandyopadhyay’)
"স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ছি
মায়ের
নাম .....
মা
আমার চুল আঁচড়ে দিচ্ছে,
বাবা
জুতোর ফিতে বেঁধে দিচ্ছে
এই
প্রথমবার বাবার মুখ দেখলাম
চাঁদের
মতো সুন্দর আমার বাবা।
আমি পিঠে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাচ্ছি।“ [ মায়ের নাম ..... , বাবা জানি না : স্বরচিত ]
ভারতের নাগরিক হওয়ার সুবাদে আমার বাবার অভাব নেই। চটে
যাবেন না প্লিজ !
যিনি জন্ম-দাতা তাঁর নাম সব কাগজ-পত্রে আজও অম্লান আছে । শুধু গত প্রায় ১৫ বছর ক্রমে-ক্রমে চোখের নাগালের বাইরে, আমার বাবা। কিন্তু আমরা ভারতীয়, আমরা বাঙালি এবং মা'র সন্তান। সুখে বা অসুখে দিদির সব ভাইয়ের-ই মা বলিতে প্রাণ করে আনচান।
মা-এর বহুবচন গ্রাহ্য কিন্তু বাবা-র নৈব-নৈব চঃ। অথচ, স্কুল পড়ুয়া আমাকে শেখানো হয়েছিল জাতির জনক নাকি কোথাকার কোন গুলি খেয়ে হায়-রাম বলতে বলতে মারা যাওয়া কোনও এক গুজরাটি। তারপর, বাবাদের সিলসিলা বা কারনামা এই মহান দেশে এখনো স্বমহিমায় বলবৎ। আবার 'মায়ের ঠিক আছে কি না' এনিয়ে কারো মাথা-ব্যথা নেই, কিন্তু বাপের ঠিক নেই - কত সহজে বলা যায়। বাবা-কে, মা 'জানে' , যুধিষ্ঠির উবাচ - অথচ তাঁদের প্রতি আমাদের মমতা ( দিদি case দিও না, please ) কোথাও কম পড়েছে , no never। কী অপরিসীম হিপোক্রিসি !
বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডাউন মেমরি লেনে চলাচল। স্কুল জীবনে কোনো রচনায় মাই ফাদার, মাই হিরো; পেন দিয়ে বেরোয় নি আমার ; কিন্তু কেন ? শুধু রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা এনে দেবেন বলা লোকটার জন্য কম কাগজ-কালি নষ্ট করিনি আমি। অথচ, যে মানুষ, উদয়াস্ত পরিশ্রম করে আমার জন্য দু-দণ্ড আকাশ দেখার সময় পেতেন না সেই মানুষ-টা হিরো নন ?
আমার বাবার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় সরাসরি ; মার্ক টয়েন যদি তাঁর তিন বছর বয়সের কথা লিখতে পারেন তো আমিও বাপের ব্যাটা জন্মের তিন ঘন্টা পরের ঘটনা সব মনে রেখেছি। সেখানে মাকে কোন দ্বায়িত্ব নিতে হয়নি। কারণ, সন্তান লালন-পালনে বিশেষ একটি প্রকৃতিদত্ত ক্ষমতা ছাড়া বাবা পারতো না হেন কোনো কাজ নেই। আজ, মাঝে মাঝে যখন একলা হাঁটি রঙ্গীতের তীর ধরে দক্ষিণ অভিমুখে বড় একা লাগে। বারবার মনে হয় বাবাকে যদি ঠিক-ঠিক কপি-পেস্ট করতে পারতাম তাহলে আমাদের একমাত্র সন্তান মন হয়তো আমাকে নিয়েও এক ছটাক গর্ব করতে পারত; but I have missed the train ! কিন্তু ব্যক্তিগত স্তরে আর কোন-ও আরোহণ নয়; এখন শুধুই নেমে চলা, রঙ্গীত পেরিয়ে তিস্তা'র উজানে বয়ে চলা।
ইংরেজি বানান syllable ভেঙে সঠিক লেখা ও উচ্চারণ কীভাবে করা যায়, হ্যারিকেনের আলোয় আমাকে দিয়ে পরম ধৈর্যে মন্ত্রবৎ আউড়াবেন যিনি, তিনি আমার বাবা। বাংলাদেশ যুদ্ধের পরে নিজ-ভুমে টিকতে না পারা একজন অতি সাধারণ মানুষ নিজের সামান্য রোজগার সত্বেও তার বাবা-মা, ভাই-বোন দের একান্নবর্তী পরিবারের বড়কর্তার মতো আশ্রয় দেবেন, উদ্বাস্তু হয়ে যেতে দেবেন না যিনি, তিনি আমার বাবা। ১৯৭৮-র বন্যায় রাতের পর রাত জেগে বন্যার্তদের মুখে দু -মুঠো খাবার তুলে দেওয়ার যে অমানুষিক প্রয়াস জারি রেখে নিজের পরিবারকে ভুলে যাবেন যিনি, তিনি আমার বাবা। ১৯৮৪-র শিখদের ওপর মর্মান্তিক অত্যাচারের সময় আমাকে নিয়ে নিউ আলিপুর পেট্রল পাম্পের সামনে রুখে দাঁড়াবেন যিনি, তিনি আমার বাবা। শ্মশানে অসভ্য ডোম-এর অতিরিক্ত টাকার দাবি-কে নস্যাৎ করে সেই ডোম-কে কাঁধে তুলে জ্বলন্ত চিতার দিকে এগিয়ে যাবেন যিনি, তিনি আমার বাবা। ল্যাং খেয়ে ফুটবল মাঠ থেকে হেরে ফিরে আসা আমাকে পরের দিন পাল্টা ঠ্যাং ভেঙে দিয়ে আসার উপদেশ দেবেন যিনি এবং বাধ্য সন্তানের মতো আমি কুকর্ম সুচারু সম্পন্ন করার পর স্মিত হেসে ঠ্যাং ভাঙা ছেলেটাকে নিয়ে হসপিটালে দৌড়োবেন যিনি , তিনি আমার বাবা। পাড়ায় শীতলা পূজার দন্ডি কাটা চলছে এক মস্তানকে কোমরে ওয়ান সটার গুঁজে মহিলাদের সঙ্গে অসভ্যতা করতে দেখে এক প্রচন্ড চড়ে তাকে এলাকা ছাড়া করবেন যিনি, তিনি আমার বাবা। ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে নিত্য পূজা করতেই হবে। শিব রাত্রিতে চার প্রহর রাতভর বাৎসরিক পূজায় রাত জেগে তার শিবরাত্রির সলতে-চন্দন কে পূজার সামগ্রী রেডি করতে হবে। সেই টিপিকাল মিডলক্লাস মানুষ কাকভেজা এক মুসলিম ছাতা সারাইওয়ালা-কে সাথে নিয়ে খেতে বসবেন সেখানে আমাকে -ও একসাথে খেতে হবে এবং ছাতা সারাইওয়ালার এঁটো বাসন সে নিজে মেজে দেবে এই অনুরোধ কানে তুলবেন না যিনি, তিনি আমার বাবা। প্রবল কংগ্রেসি জমানায় , সত্তরের দশকে পাড়াতুতো এক নকশাল ভাই-কে শেল্টার দিয়ে পুলিশ-প্রশাসন কে বাপি বাড়ি যা করে দেবেন যিনি, তিনি আমার বাবা। তেমনি দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএমের যুগে কংগ্রেস একটা ভোট পেলে সেটা আমার দেওয়া জানবে সপাট বলে দিতে একটুও বুক কাঁপবেনা যার, তিনিই আমার বাবা। সরশুনায় বাড়ি করে আসার পরের ঘটনা, আজকের মুখ্যমন্ত্রী তখন যুব কগ্রেস নেত্রী। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক তখন অনিল বিশ্বাস; প্রকাশ্যে তীব্র ব্যক্তিগত ও কুরুচিকর আক্রমণ করলেন মমতা ব্যানার্জী-কে, যা ছাপার অক্ষরে আর নাই বললাম। একজন মহিলার প্রতি এহেন বদ-মন্তব্যের প্রতিবাদ করে লেখা আমার একটি প্রতিবেদন তখন সংবাদ প্রতিদিন-এ প্রকাশিত হয়েছিল। আরো পরে, অধ্যাপক অমর্ত্য সেন নোবেল পুরস্কার পেলেন; তখন তাঁর তত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন যে দুজন, তাঁদের একজন কলকাতা বিশ্ব-বিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রফেসর ড. রতন খাসনবিস ও এই আমি যথাক্রমে আনন্দবাজার পত্রিকা এবং সংবাদ প্রতিদিনে। ব্যাস পরের দিন শুরু হয়ে গেলো সিপিএমের বিখ্যাত চিন-মিউজিক। আসতে-যেতে, বাড়িতে-চায়ের দোকানে সর্বত্র চিন-মিউজিক। তখন বাবা বেশ অসুস্থ তথাপি ঢোক গিলতে বারণ করবেন যিনি, তিনি আমার বাবা। দিল্লিতে এশিয়ান গেমস চলছে। তখন খেলার মাঝে-মাঝে দূরদর্শনে সিনেমা দেখানো হত। এক সন্ধ্যায় দেখি সত্যজিৎ রায়ের সদ্গতি। পরের দিন, বাবা যে কারখানায় কাজ করতেন সেখান থেকে সরাসরি সত্যজিৎ রায়কে ফোন করে জবাবদিহি চাইবে যে, সেই আমি তখন পঞ্চম শ্রেণী। কিসের জবাবদিহি ? কেন ফিল্মের শেষ ওভাবে করা হয়েছে ? কী অপরিসীম ধৃষ্টতা। আমার মধ্যে অপরিমেয় স্পর্ধা যিনি জারিত করেছেন, সেই তিনিই আমার বাবা। এমনকি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রশ্রয়ে, একবার স্বয়ং গুলজার সাহেব-কে সিলসিলার শেষ পর্ব নিয়ে আমি তীব্র ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছি। উনি যে আদতে প্রতিভাধর টাকা কামানোর মেশিন এবং অত্যন্ত compromising character সে-সব অত্যন্ত নিন্ম রুচির শব্দ প্রয়োগের ধৃষ্টতা বাবার নীরব আদরের পরিণামে চূড়ান্ত বাঁদরামি ছাড়া আর কিছু নয়।
আপাতত, আর একটা ঘটনা যা Indweller's WEism এর
WhatsApp গ্ৰুপে এখনো রয়েছে সেই প্রসঙ্গে সামান্য কিছু জানানো উচিত বলে
মনে করছি তারই উল্লেখ করে, এই
আবেগ সংবরণ করবো নিতান্ত ভবিষ্যতের বাণিজ্যিক তাগিদে।
যে দুজনের প্রস্তাব ও পাল্টা প্রস্তাব পেলাম ও পড়লাম তাদের কারো প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা আমার পক্ষে বেশ কঠিন। আমার অবস্থা শ্যাম রাখি না কূল রাখি । এলিজার প্রস্তাব মোতাবেক, সিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢোকার মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম বাবা-কে নিয়ে কী ভাবি তা লিখবো বলে। এমন সময় ছোটবেলার বন্ধু, এখন পাঁচ দিনের বড় দাদা দেবব্রতর পোস্ট ‘‘Instead of that one (as proposed by Eliza) we can teach our next generation how to take care of their parents.’’ আমার মনে পড়ে না 'এটা পড় -ওটা পড়, এটা না - ওটা ' বাবাকে এসব উচ্চারণ করতে কখনো শুনিনি । এক নির্বিকল্প ব্যকরণ-হীন মানুষ, জীবনচর্যা-র থেকে আর অন্য কোন প্রথাগত-শিক্ষায় তার বোধহয় তেমন কোন রুচি ছিলনা। দেবব্রত ও অন্য সবাই-কে শুধু বলব, শেখার আগ্রহ আমার যেন আজীবন থাকে, নজর রাখিস ; যখন দেখবি আর শিখছি না বুঝবি খেলা শেষের বাজনা বেজেছে , তবুও আমার নজরে আনিস। আর, শেখানো; না এতো ধৈর্য্য আজ আর আমার নেই। আর আমি ছাই কী শিখেছি যে শেখাব ? গার্ডিয়ানগিরি করাও আমার কাজ নয়। আমার জীবন খোলা বই, যদি পড়ার আগ্রহ থাকে নিশ্চয়ই পড়বে। জীবন কোনো ফর্মুলা নয়। বড়জোর আগ্রহ তৈরি করার কিছু উপাদান ছোটদের সামনে হাজির করতে পারি। যেমন, ছোটদের অনেকেই ফাস্ট-ফুড খেতে ভালোবাসে ; আমার বাবা আমাকে নিউ মার্কেট এর নাহুম , চৌরঙ্গিতে অনাদির মোগলাই পরোটা , রাম মন্দিরের সামনে ফুচকা , পার্ক স্ট্রিট এর fluryce, উত্তর কলকাতার গিরিশ চন্দ্র দে - নকুড় চন্দ্র দে র বিখ্যাত সন্দেশ সব-সব স্বাদ চাখতে ও চাখাতে নিয়ে নিয়ে ঘুরতেন। কিন্তু এর কোনোটাতেই আমি মন-কে নিয়ে যেতে পারিনি। কারণ আমার বাবা নিতান্ত ছাপোষা একজন অতি সাধারণ বাবা ছিলেন, আর মনের বাবা একজন টাকা দিয়ে খালাস পেতে চাওয়া অসাধারণ ব্যস্ত বাবা। তাই শেখানোর থেকে আর যে কদিন আছি আরো দু'ছটাক শিখতে পারার দিকে আমার মন পরে থাকবে।
আগামী দিনে স্কুল-কলেজ-ইনস্টিটিউট-অফিসে সর্বত্র আমার প্রিয় শিক্ষকদের মধ্যে বারবার করে আমি আমার বাবাকে খুঁজে পেয়েছি; । আর তাই, রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে বাবা ছাড়া আমি অচল।’’
এসব, নিতান্ত আবেগ এর বহিঃপ্রকাশ নয়। আমার মতো-ই আমার বাবার জৈবিক ভাই-বোনেদের কারো সঙ্গেই আর কোনো যোগাযোগ নেই। প্রয়োজন বা তাগিদ সেসব ফুরিয়েছে অনেক আগে। তবুও নিতান্ত আবেগ যে নয় তার সাক্ষী বাবার এক ভাই আমার এখন একমাত্র কাকু মুকুন্দলাল বসু এবং আমার একমাত্র মামা দুলাল গাঙ্গুলী (যাদের নিয়ে আগামী দিনে লেখার ইচ্ছে আছে )।
এই মহান ম্যা-ম্যা এর দেশে, বাবা সবসময় ব্রাত্য, প্রায় হেড চাকর-বাকর গোছের মানুষ। যদিও সপ্তপদীর রিনা ব্রাউন বা আমার এক-আধ জন বন্ধু-বান্ধবীর বাবা, এরকম এক্সসেপশনাল মডেলের সংখ্যাও এদেশে খুব কিছু কম নয়। তাদের কথা পরে, কিন্তু হবে ………. Acknowledgment: Thank you Señorita, for your kind words and encouragement and, had you not edited and transformed this, I would have definitely missed the train! Thank you once again.
Comments