এলিজা গায়েন – চন্দন বন্দ্যোপাধ্যায় সদা সত্য কথা বলবে
সদা
সত্য কথা বলবে সত্য বৈ মিথ্যা কখনো বলিবে না। মিথ্যা বলা মহা পাপ !
কিন্তু বর্তমান অবস্থা বেশ ভিন্ন। গত পরশু যা ছিল সত্যের
আশা, গতকাল তা দৃষ্টিতে ঝাপসা, আজ বাস্তবে দুর্দশা, আগামীকাল ঘন কুয়াশা, পরশু হয়ত
মিথ্যের হতাশা। ছোট বেলায় জ্বর হলে ভাত নিষিদ্ধ, আর এখন তো বলে বেশি করে খেতে। সারাজীবন
শুনলাম Metronidazole পেটের অসুখে খায়, সেদিন দেখলাম দাঁতের অপারেশনের পরে এক রোগীকে
Metronidazole দিয়েছে। কোথায় দাঁত আর কোথায় Metronidazole লোকেশন! পরে এক ডাক্তার
বন্ধু বলল, খুবই ক্লোজ রিলেশন নাকি দুটোর মধ্যে, যেনতেন নয় - গায়ে গায়ে, ফার্স্ট কাজিন।
শোনার পরে এই সংক্রান্ত একটা গল্প মনে পড়ে গেল। দুজন ডাক্তারের চেম্বারের দরজা পাশাপাশি।
এক দাঁতের রোগী ভুলে ডেন্টিষ্ট এর চেম্বারে না ঢুকে পাশের দরজা দিয়ে পাইলস এর ডাক্তারের
চেম্বারে ঢুকে পড়েছেন। ঢোকামাত্রই এসিসট্যান্ট এর নির্দেশ -- শুয়ে পড়ুন । অগত্যা
তিনি শুয়ে পড়লেন। দুজন এসিসট্যান্ট একসাথে এসে বললেন -- রোগ হয়েছে লজ্জা কিসের?
বলতে বলতেই, চার হাত দিয়ে চিৎ হওয়া অবস্থা থেকে উপুড় করে দিলেন। কিছু বলবার আগেই
ডাক্তার গ্লাভস পড়ে রেডি। রোগী বৃথা চেষ্টা করছে চিৎ হতে। অস্থিরতা দেখে ডাক্তার সহজ
করার জন্য জিজ্ঞেস করলেন
-
ভয় পাচ্ছেন নাকি ?
-
হ্যাঁ।
ডাক্তার
বলছেন -- ভয় কিসে ? রোগী বলছে –
ডাক্তার বাবু,, এত লম্বা রাস্তায় দাঁত তুলবেন কী করে ?
সবসময় সত্য
বলা কি বাধ্যতামূলক ? ঠিক জানি না । কারণ, এই দীর্ঘ জীবনে হাড়ে-হাড়ে উপলব্ধি করেছি
যে, সত্য কথা-র সঙ্গে শান্তি-র সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক।
বিশেষ করে
প্রেম; সে বয়স আপনার যাই হোক। তবে ব্যাপারটা মানে ওই অশান্তি আর কী কেটে ছানা হয়ে যায়
যদি আপনি সত্যি কথা বলেন। প্রথম-প্রথম সুমনের সাদা মনে কাদা ছিল না। সদা সত্য বলত।
সুমন -এর নিজের মুখেই শুনুন না হয় – শুধু স্যালারি-টা ঠিক কত এটা -- অশ্বথামা হত ইতি
গজ:, বাকিটা মাইরি বলছি সঅব সত্যি কথা নো নক্কা-ছক্কা; সব সত্যি কথা । যদিও, জীবন-সঙ্গী,
মানে সুহানা-কে এমন কোনো মাথার দিব্বি ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন-এর সময় আমি দিয়েছিলাম বলে
আমার তো মনে পরে না। আর আমি তো ছাড় যাদের দেখে Extra Marital Affairs প্র্যাক্টিস করবো
বলে উৎসাহিত হয়েছিলাম তাঁরা-ও বিন্দাস সত্য-পথ ছেড়ে আজ তুলসীতলা তো কাল যমুনা -বিহার
করেছেন ! তো যা বলছিলাম, বালুরঘাট। যাচ্ছি
-- অমিতাভ-সুচিস্মিতা-র ডাকে নাট্য-উৎসব আছে রায়গঞ্জে । ডিনার সেরে ট্রেনে উঠে, ফোন
করলাম। কারণ, লাইভ জিও-লোকেশন জানিয়ে রাখলে রাত-বিরেতে জেরা-র ধাক্কা অন্তত কিছুটা
কমে। নিচের তলা-য় এক রোগাটে গোবেচারা ভদ্রলোক ও তার সঙ্গে এক মহিষাসুরমর্দিনী সাত-সতেরো
খাবারের বাক্স খুলে ; এই এটা খাবে না, ওই ওটা খাবে না শুরু করেছে, ভাব দেখে কেমন যেন মহিষাসুরমর্দিনীকে,
রোগা-পাতলা গোবেচারা ভদ্রলোকের দুর্ভিক্ষের কারণ বলে মনে হলো।
এদিকে লাগ্
ভেলকি লাগ্, সুহানা তখন ফোনে -- এখুনি ভিডিও কল কর, তোর সঙ্গে কে, কি, কেন, কবে,
কোথায় ? সে রাতে নয়-নয় করে আঠারো-টা ভিডিও কল ! সকালে গুড মর্নিং বলার আগেই আবার -
তুই যে বললি বালুরঘাটে আত্রেয়ীর সঙ্গে দেখা হবে। তখন কেন যে তলিয়ে ভাবিনি, তা সে কি
তোর সঙ্গে কলেজে পড়তো, না কি Ex ? তোর যা অকাজ-কুকাজ করার অভ্যাস ! আচ্ছা যদি কলকাতার মেয়ে হয়,
তাহলে বালুরঘাটে বিয়ে করলো কেন ? -- সত্যি কথা বলতে কি, এরপর থেকে আমি ট্রেনে-বাসে
ওঠা বন্ধ করে দিয়েছি। এখন দি-পু-দা বা কাছে-দূরে যেখানেই যাই হেঁটেই যাই, আর তাতে বুঝলেন খরচ-টা ঠিক অর্ধেক হয়ে যায় কি না "।
চলুন গল্পটা
রি-স্টার্ট করা যাক -- বইতে যা আছে, যেমন - কাঠুরের গল্পটা তো ছোটবেলায় আমরা সকলেই
পড়েছি। একটু রিফ্রেশ করে নেওয়া যাক -
এক কাঠুরিয়া
কাঠ কাটছিল। হঠাৎ করে তার হাতের কুড়ুলটি পুকুরের জলে পড়ে যায়। গরীব কাঠুরিয়া কিভাবে
আবার কুড়ুল কিনবে। তাই মনের দুঃখে পুকুরের পাড়ে বসে কাঁদছিল। এই সময় তার কান্না শুনে
জলদেবতা উঠে এলেন এবং কাঠুরিয়াকে কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করে সব জানতে পারলেন। অথচ
এযাবৎ, আমাদের মিথ্যা শেখানো হয়েছে যে তেনারা নাকি সর্বজ্ঞ! এরপর চোখের নিমেষে জলের
নীচ থেকে একটি সোনার কুড়ুল এনে
কাঠুরিয়াকে
বললেন -
- এটা তোমার
কুড়ুল ?
- না।
তারপর আবার
ডুব দিয়ে এবার একটি রুপোর কুড়ুল আনলেন এবং যথারীতি আগের বারের মত কাঠুরিয়া না বললে
জলদেবতা এবার, কাঠুরিয়ার কুড়ুলটি নিয়ে এসে দেখালে কাঠুরিয়া বলল -
- আজ্ঞে হ্যাঁ।
এটিই আমার কুড়ুল।
জলদেবতা কাঠুরিয়ার
সততায় মুগ্ধ হয়ে তিনটি কুড়ুলই দিয়ে দিলেন পুরস্কার স্বরূপ।
এবার অন্য একটি গল্প শোনা যাক। একবার এক লোক রাস্তায় একটা বইয়ের কয়েকটি পাতা কুড়িয়ে পেলেন এবং দেখলেন সেখানে বিভিন্ন রকম রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি বর্ণিত। তাই সযত্নে কাগজগুলোকে আলমারিতে তুলে রেখে দিলেন। কিছুদিন পরে তার স্ত্রীর জ্বর হল। লোকটা কাগজগুলো বের করে পাতা ওলটাতে ওলটাতে জ্বরের চিকিৎসা পদ্ধতি পেয়ে গেল - "একটি লৌহ দণ্ড রক্তের ন্যায় লাল বর্ণ ধারণ না করা পর্যন্ত আগুনে গরম করিতে হইবে। অতঃপর উক্ত লৌহদণ্ডটি দ্বারা পশ্চাদ্দেশে তিনটি ছ্যাঁকা দিতে হইবে।"
যেমন লেখা তেমন কর্ম, যেমন কর্ম তেমন ফল।
স্ত্রী হাসপাতালে আর লোকটা চোদ্দ শিকের ভিতরে। লোকটি বারংবার বলার পরেও কেউই স্বাভাবিকভাবে বিশ্বাস করল না যে এসব বইয়ে লেখা আছে। বাধ্য হয়ে লোকটা তার এক আত্মীয় মারফত বইয়ের পাতাগুলো আনিয়ে পুলিশকে দেখাল। পুলিশ পড়ে কিছুটা আশ্চর্য হলেও নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালে ডাক্তারদের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তাররাও পড়ে অবাক। সিনিয়র একজন ডাক্তার পাতাটি উল্টিয়ে দেখলেন পরের পাতায় লেখা - পরবর্তী তিনদিন গরুকে গোসল না করানোই বাঞ্ছনীয় !
পৃথিবীতে হয়ত ধ্রুব সত্য হিসাবে আমরা যা জানি, দায়িত্ববান কোন ব্যক্তি হয়তো বা ভুল করে হোক, বা দায়িত্বে অবহেলার কারণেই হোক, পাতাটি উল্টাতে ভুলে গিয়েছিলেন। ঐ একই কারণে হয়তোবা ঐ কাঠুরিয়ার গল্পের বইটি যখন ছাপানো হয়, তখন ছাপাখানায় পরের পাতাটি, অর্থাৎ শেষ পাতাটি না উল্টানোর কারণে পুরোটা ছাপানো হয়নি।
মুল গল্পের বাকী অংশ, যেটি ছাপানো হয়নি, সেটি আমরা আরাকু ভ্যালির ডরাকু গুহা'র গভীর অন্ধকার থেকে উদ্ধার করেছি। এখন পাবলিক ডোমেইন-এ প্রকাশ করছি।
কিছুদিন পরে ঐ কাঠুরিয়ার বউ পুকুরে স্নান করতে গিয়ে পায়ে কাপড় জড়িয়ে, ঐ পুকুরের জলেই ডুবে গেল। কাঠুরিয়া আগের মতই চিৎকার করে কাঁদছে আর প্রবল উৎসাহে কান্নাকাটি করছে –
- ও আমার sonta-monta বউ, তুমি আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেলে ? এই বয়সে বউ হারালে তো পুরুষ মানুষও বিধবা হয়ে যায় গো।
আমার এখন কি হবে গো ? আমি এখন কি নিয়ে বাঁচব গো ? গো -গো।
জলদেবতা আগের মতই এলেন এবং শুনলেন। মুহূর্তের মধ্যে জল থেকে তুলে নিয়ে আসলেন এবং সাথে সাথে সাম্বা-সাম্বা হো-হো ………
মিউজিক শুরু হয়ে গেল -
- মাই নেম ইজ আলিয়া ভাট, তুম কেয়া মিলে। .....! সাথে সাথে আলিয়া ভাটের সেই বিখ্যাত কোমর বাঁকানো নাচ। কাঠুরিয়ার চোখের পলক পড়ছে না, শরীরে একটা চিকন ঘাম দিয়ে গেল, হার্ট-বিট বেড়ে গেল ও মুখটা হাঁ-ফাঁক করা।
জলদেবতা বললেন -
- তোমার বউ?
কোনও উত্তর নেই। তাই জলদেবতা এবার জোরে বললেন -
- এই কি তোমার বউ?
আলিয়া-র দিক থেকে চোখ না সরিয়ে, মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শুধু একটি শব্দ করল কাঠুরিয়া -
- আহ!
এর সাথে হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গীতে ইশারা করল চলে যাবার জন্য। জলদেবতা এবার একটা জোরে ধাক্কা দিলে কাঠুরিয়া জলদেবতার দিকে তাকিয়ে বলল -
- খালি বিরক্ত করেন, বাঙালরা কি কয় হেইডাও জানেন না দেখতাছি- কামের সময় আমের দোকান ভাল লাগে না। কি বলতে চান তাড়াতাড়ি বলেন। টাইম নাই।
জলদেবতা বললেন -
- মেয়েটা কি তোমার বউ ?
- অবশ্যই, আবার প্রশ্ন !
- ছি, ছি ! সেদিন তোমার সততায় আমি কত মুগ্ধ ছিলাম, কিন্তু আজ আমি একি দেখলাম? একটা সুন্দরী মেয়েকে দেখে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেল ! দুশ্চরিত্র, লম্পট কোথাকার, তুমি বউ তো পাবেই না, উপরন্তু শাস্তি স্বরূপ তোমাকে দেয়া তিনটি কুড়ুলই আমি ফেরত নিয়ে যাচ্ছি।
- হ্যালো, মিস্টার জলদেবতা, মুখ সামলিয়ে কথা বলবেন। দেওয়ার মালিক আপনি, নেওয়ার-ও মালিক আপনি। নিয়ে যান। আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু আমাকে কোন সাহসে দুশ্চরিত্র এবং লম্পট বললেন, তা এই পুকুর পাড়ের মাটিতে দাড়িয়েই আপনাকে জবাব দিতে হবে। ইয়ার্কি মারতা হ্যায় ?
- তুমি একটা সুন্দরী মেয়ে দেখে নিজের বউকে ভুলে গিয়ে এই আলিয়াকেই বউ বলছ ? লজ্জা করেনা ! ছি, ছি ।
- হ্যালো জলদেবতা আপনি কি আমার কাকা শ্বশুর নাকি, আপনার খেলা আমার বোঝা শেষ। এরপরে একটা কম সুন্দরী ও শেষে আমার বউকে আনবেন। আমি হ্যাঁ বললাম আর আপনি তিনজনকে-ই আমাকে দিয়ে দিতেন। তিন বউ নিয়ে যারা সংসার করে, তাদেরই চরিত্র খারাপ, তারাই লম্পট। আমি তো সেই ক্ষেত্রে এই মেয়েকে পেতামই, সাথে আরও দু-দুটো বোনাস পেতাম, একটা নিলে দুটো ফ্রি ! তিন বউ মানে সংসারে অশান্তি। আর, আমি যেহেতু সৎ পথে পয়সা উপার্জন করি, তাই তিন বউকে পোষার মত সামর্থ্যও আমার নেই। আমি সৎ এবং চরিত্রবান মানুষ। আমি আমার সততায় অনড়। আপনার যা ইচ্ছা আপনি করতে পারেন।
জলদেবতা বেবাক চুপ।
বাধ্য হয়ে জলদেবতা আলিয়া ভাটকে রেখে চলে গেলেন। কাঠুরিয়া আলিয়া ভাটকে নিয়ে ঘরের ভিতর টুকুস টুকুস করে গল্প করে খানিকক্ষণ, এরপর একটু খিলখিল হাসি, তারপর কিছু সময়ের জন্য নীরবতা।
কাঠুরিয়ার খোঁজে সেই গ্রামে গিয়েছিলাম আমরা। এক মুদি দোকানি বললো, সাতদিন বাদে-বাদে দরজা খুলে বাইরে বের হয় কাঠুরিয়া। সোনার কুড়ুল থেকে এক-এক টুকড়ো কেটে নিয়ে বাজারে গিয়ে বিক্রি করে, একবারে সাতদিনের বাজার করে ঘরে ফেরে। এরপরে আবার সাতদিনের জন্য দরজা বন্ধ। শুধুই টুকুস টুকুস... খিলখিল...নীরবতা... টুকুস টুকুস... খিলখিল...
Comments